মেজর ডালিম বলেছেন, মুজিব ছিলেন ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান ভূমিকা পালনকারী।

    মেজর ডালিম
 

প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের আলোচিত লাইভ টকশোতে ৪৯ বছর পর প্রকাশ্যে কথা বললেন শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর শরিফুল হক ডালিম (বীর উত্তম)। টকশোর একপর্যায়ে শেখ মুজিব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, মুজিব ছিলেন ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান খেলোয়াড়।

রোববার (৫ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত এ টকশোটি দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায়। বাংলাদেশে লাইভ টকশোর ইতিহাসে নজিরবিহীন সাড়া ফেলতে একসঙ্গে প্রায় ৮ লাখ দর্শক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।

টকশোতে মেজর ডালিম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নেপথ্যের ঘটনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। বিদেশে নির্বাসিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নিজের জীবন, মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক ইস্যুতে কথা বলেন।

টকশোর শুরুতে মেজর ডালিম বলেন, "দেশবাসী, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতাকে লাল শুভেচ্ছা জানাই, যারা আংশিক বিজয় অর্জন করেছেন। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সম্পূর্ণ বিজয়ের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।"

তিনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "সম্প্রসারণবাদী-হিন্দুত্ববাদী ভারতের কবজায় আমরা প্রায় চলে গিয়েছি। ৭১ সালের মতো আরেকটি স্বাধীনতা অর্জন না করলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।"

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় প্রোপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্র নিয়ে মেজর ডালিম বলেন, "ভারত প্রমাণ করতে চেয়েছে যে বাংলাদেশের জনগণ নিজেরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেনি। বরং এটি ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলাফল, যেখানে ভারত বিজয়ী হয়েছে। এখান থেকেই ইতিহাসের অপব্যাখ্যা শুরু।"

জাতীয় সংগীত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবর্তে কাজী নজরুল ইসলাম বা অন্য কোনো দেশীয় কবির রচনা হতে পারত। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসে এমন উদাহরণ বিরল যেখানে ভিনদেশী কেউ কোনো দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা।"

১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে মেজর শরিফুল হক ডালিম (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ের অনেক অজানা গল্প তুলে ধরেন।

১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রশ্ন। নিজের কাজ নিজে তুলে ধরা যায় না। তবে প্রথমত, ১৫ আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সূত্রপাত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। তখনই আমরা বুঝতে পারি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বার্থে হচ্ছে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।"

তিনি আরও বলেন, "যখন সাত দফা চুক্তির মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদ এবং কাজী নজরুল ইসলামকে প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট গঠনের অনুমতি দেওয়া হলো, তখন সেই চুক্তির সাতটি ধারা পড়ে কাজী নজরুল ইসলাম এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, আমরা ধীরে ধীরে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হব।"

১৫ আগস্টের ঘটনার প্রসঙ্গে মেজর ডালিম বলেন, "মুজিব মারা যাননি, তিনি একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। বাকশালের পতনের পর কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে শুকরিয়া আদায় করেছে। তার মৃত্যুর পর লাখো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ মিছিল করেছে। আমরা তাদের ডেকে আনি নাই, এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছে। এভাবেই ধানমন্ডি ৩২-এর সামরিক অভ্যুত্থান জনস্বীকৃতি পেয়েছিল।"

তিনি শেখ মুজিবের শাসন নিয়ে বলেন, "মুজিব তার শাসনকে এতটাই স্বৈরাচারী করে তুলেছিলেন যে, মানুষ তার জুলুম থেকে মুক্তির জন্য রবের কাছে প্রার্থনা করছিল।"

শেখ মুজিব সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "মুজিব ছিলেন ভারতীয় নকশা বাস্তবায়নের প্রধান খেলোয়াড়।"

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, "যখন তথাকথিত নেতারা ভারত পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ ছিল না, তখন পাকিস্তান বাহিনী বাঙালিদের ওপর হামলে পড়েছিল। সেই সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি আসে। আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে ছিলাম। তার ঘোষণা শুনে মনে হলো আর বসে থাকার সময় নেই। এরপরই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।"

মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং অসংখ্য নারী সম্ভ্রম হারানোর বিষয়ে সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের প্রশ্নের জবাবে মেজর শরিফুল হক ডালিম বলেন, "এই সংখ্যাটি কীভাবে সৃষ্টি হলো, তার ইতিহাস মনে করিয়ে দিই। মুজিব যখন সিরাজ ভাই এবং রেজাউল করিম সাহেবকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সত্যিই কি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, নাকি আমাকে কোথাও নিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে? তখন সিরাজ ভাই উত্তর দেন, ‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। তবে আপনি কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছেন, সেটা আমরা বলতে পারব না। এটা আপনার সিদ্ধান্ত।’’

ডালিম আরও বলেন, "মুজিব তখন সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করেন, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু? সিরাজ ভাই তখন জানান, ‘সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় তিন লাখের মতো।’ কিন্তু পরে যখন মুজিবকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘যুদ্ধকালীন প্রাণহানির পরিমাণ কত?’ তখন তিনি উত্তর দেন, ‘থ্রি মিলিয়ন (তিন মিলিয়ন)।’ এভাবেই তিন লাখ হয়ে যায় তিন মিলিয়ন। সেখান থেকে সংখ্যাটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেটি এখনো প্রচারিত হচ্ছে।"

জাতির পিতা ইস্যুতে মেজর ডালিম বলেন, "আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতির পিতা, জাতির মাতা, জাতির বোন, জাতির জামাই—এসব ধারণায় বিশ্বাস করি না। জাতির পিতা বলতে হলে বিশ্ব মানবতার পিতা হযরত আদম (আঃ)। এটি কেউ অস্বীকার করতে পারে না। উন্নত দেশগুলো থেকে তোমরা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার শিখে আসছ, কিন্তু কুরআনে কি এগুলো নেই? তারপরে এসব উন্নত দেশে কেন জাতির পিতার ধারণা নেই? আমাদের এখানে কেন এটি থাকতে হবে?"

তিনি আরও বলেন, "ভারতে কে জাতির পিতা? সেখানে জাতির পিতার কোনো ধারণা নেই। কোনো সভ্য দেশে ‘জাতির পিতা’ নামে কিছু নেই। আমাদের এখানেই কেন এটি বাধ্যতামূলক?"

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে মেজর শরিফুল হক ডালিম বলেন, "তাদের মেন্টর ভারত, যেখানে তারা পালিয়ে গিয়েছিল, সেই দেশটাতে কি কোনো জাতির পিতা আছে? নেই। তাহলে আমরা কেন ‘জাতির পিতা’ বলব? যুক্তিটা কী? বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে রাজনীতিতে শুধু কি শেখ মুজিবের অবদান ছিল? সেখানে মাওলানা ভাসানীর নাম নিতে হবে না? শেরেবাংলা ফজলুল হকের নাম নিতে হবে না? একমাত্র মুজিবই কি বাংলাদেশের ঠিকাদার? আমি তো তা মনে করি না।"

তিনি আরও বলেন, "মুজিব কখনোই স্বাধীনতা চাননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা প্রথম বলেছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা ওয়াজ্জেল হোসাইন। যার যা প্রাপ্য, তাকে সেই মর্যাদায় সম্মান দিতে হবে।"

ডালিম দাবি করেন, "১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিব পাকিস্তান আর্মির হেফাজতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের আগে তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে যান। নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তিনি পাকিস্তানে পাড়ি জমান।"

তিনি আরও বলেন, "স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। কিন্তু পরে ভারতের চাপে শেখ মুজিবের নাম সেই ঘোষণায় যুক্ত করতে বাধ্য হন জিয়া।"

দীর্ঘ দুই ঘণ্টার টকশোতে তিনি ইতিহাস থেকে আরও কিছু বিতর্কিত দাবি তুলে ধরেন। তার বক্তব্যগুলো নিম্নরূপ:

  • আলবদর বাহিনী নয়, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল ভারতীয় বাহিনী।
  • ভারত তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। বাঁধা দিলে মুজিব মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করেন।
  • জহির রায়হান ও শহীদুল্লাহ কায়সারকে হত্যা করিয়েছিলেন মুজিব।
  • মুক্তিযুদ্ধে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির তথ্য একটি মিথ্যা প্রচারণা।
  • বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিলেন মুজিব।
  • মুজিবের ভাষণে নয়, মেজর জিয়াউর রহমানের ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়েছিল এবং আমিও পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলাম তার ডাকে।
  • ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল শুধুমাত্র দেশটিকে তাদের একটি প্রদেশে পরিণত করার জন্য।

মেজর ডালিম আরও বলেন, "মুজিবের সিদ্ধান্তগুলো ছিল স্বৈরতান্ত্রিক এবং তার কর্মকাণ্ড জনগণের জন্য নয়, বরং ভারতের স্বার্থে কাজ করত।"

Post a Comment

Previous Post Next Post