ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিন তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছে আদালত।
বিশ্লেষকদের মতে, বেসিক ব্যাংক লুটপাটে আবদুল হাই বাচ্চু একা নন; পুরো পরিচালনা পর্ষদই এই কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। তাই তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পর্ষদের সব সদস্যকে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর যোগদানের পর থেকেই বেসিক ব্যাংকে লুটপাট শুরু হয়। ব্যাংকটি লুটপাটের বিষয়টি জানা সত্ত্বেও তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর চেয়ারম্যান পদে থাকার সময় বেসিক ব্যাংকে নজিরবিহীন অনিয়ম ঘটে, যার ফলে ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়। এই লুটপাটের কারণে ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৬৪ শতাংশ বর্তমানে খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকটি ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।
বেসিক ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৫ অক্টোবর। তার সময়কালে পরিচালনা পর্ষদে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, ফখরুল ইসলাম এবং শ্যামসুন্দর শিকদার।
সিদ্দিকুর রহমানের মৃত্যুর পর বিসিকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খায়রুল আনাম একটি (২৭৬তম) পর্ষদ সভায় যোগ দেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুন নাহার আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নিলুফার আহমেদ, শুভাশিষ বসু এবং সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন।
বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ পেয়েছিলেন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী আখতার হোসেন, এআরএস লুব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস প্রতিষ্ঠান ইসলাম আফতার কামরুল অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার একেএম কামরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘উত্তরণ’-এর সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ।
পর্ষদের সদস্য রাজিয়া বেগম ও সিদ্দিকুর রহমান ২০১০ সালের ৩১ জুলাই মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁরা সেদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বেসিক ব্যাংকের একটি শাখার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।
ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন আবদুল হাই বাচ্চু। এ সময় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করেছিলেন একেএম সাজেদুর রহমান, শেখ মনজুর মোর্শেদ এবং কাজী ফকরুল ইসলাম।
- একেএম সাজেদুর রহমান ছিলেন ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
- ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ৮ জুন পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন শেখ মনজুর মোর্শেদ।
- শেখ মনজুর মোর্শেদের পর কাজী ফকরুল ইসলাম এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৪ সালের ২৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে অপসারণ করে।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আমলে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তাই পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সচিব, সচিব বা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ওই সময় পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন সাবেক সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার, যিনি পরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান হন। শুভাশিষ বসু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চেয়ারম্যান হন এবং পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পর্ষদের অন্যান্য সদস্যরাও বর্তমানে বিদেশে আরামদায়ক জীবনযাপন করছেন বলে জানা যায়।
বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি ও নানা সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা মনে করেন, আবদুল হাই বাচ্চু একা নন, তার নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) ব্যাংক লুটপাটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তারা বাচ্চুকে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের হিসাব নেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
পর্ষদের মধ্যে মাত্র দুইজন পরিচালক লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন—সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ একেএম কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান। রেজাউর রহমান ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। তবে এ প্রতিবাদের পর বাচ্চু সিন্ডিকেট রেজাউর রহমান এবং কামরুল ইসলামকে বেসিক ব্যাংকের কার্যক্রমে অংশ নিতে বাধা দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, "রাজনীতিবিদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একটি চক্র যৌথভাবে ব্যাংকটি লুটপাট করেছে। পুরো ব্যাংক খাতে যে লুটপাটের চক্র গড়ে উঠেছিল, বাচ্চু ছিল সেই ব্যবস্থার অংশ। এ চক্রের সবাইকে একযোগে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।"
Post a Comment