সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত উন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি। পাশাপাশি প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড দেওয়া ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশও করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন পরামর্শক কমিটির সদস্যরা। পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ড. মনজুর আহমদসহ অন্যান্য সদস্যরা। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে ১৪টি নির্বাচিত সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রচলিত কাঠামো ব্যাখ্যা করে ড. মনজুর আহমদ বলেন, "প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে পদায়নের দাবি উচ্চ আদালতে সমর্থন পেয়েছে, তবে সরকার এ বিষয়ে রিভিউ আবেদন করেছে।"
সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—শিক্ষক পদে প্রবেশ দ্বাদশ গ্রেডে, দুই বছর পর স্থায়ীকরণ, এবং আরও দুই বছর পর ১১তম গ্রেডে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি। তিনি আরও বলেন, "শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই প্রস্তাব কার্যকর হওয়া উচিত।"
প্রধান শিক্ষকদের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, সরকারের রিভিউ আবেদন প্রত্যাহার, প্রধান শিক্ষক পদে দশম গ্রেড নির্ধারণ এবং সব প্রধান শিক্ষককে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া।
সুপারিশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ বিলুপ্ত করে ‘শিক্ষক’ ও ‘সিনিয়র শিক্ষক’ পদ চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শিখন সময় বৃদ্ধির জন্য সব বিদ্যালয়কে এক শিফটের স্কুলে রূপান্তর করা, শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো নির্ধারণ, এবং মৌলিক দক্ষতা জরিপের ভিত্তিতে বিদ্যালয়গুলোকে সবুজ-হলুদ-লাল ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করার প্রস্তাবও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষা সংস্কার ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা
পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ড. মনজুর আহমদ বলেন, “শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো সহজ সমাধান নেই। সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সময়সীমাবদ্ধ ও সমন্বিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম ও বার্ষিক বাজেটকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।”
ভিত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন
প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হিসেবে বাংলা ও গণিতের ভিত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলা কেবল একটি বিষয় নয়, বরং অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষায় প্রবেশের চাবিকাঠি।
গণিতে মৌলিক দক্ষতা অর্জন না হলে শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত শিখনে পিছিয়ে পড়বে। এজন্য প্রতিদিন বাংলা ও গণিত বিষয়ে ৬০-৭৫ মিনিট করে শিক্ষাদানের সময় নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এক শিফটের স্কুল ব্যবস্থা
শিখন সময় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব বিদ্যালয়কে এক শিফটের স্কুলে পরিণত করা জরুরি। সুপারিশ অনুযায়ী, অন্তত ৫০% বিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে এক শিফট চালু করা এবং পরবর্তী ১০ বছরে সব বিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সর্বোচ্চ ১:৩০ রাখার প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
নিরাময়মূলক সহায়তা
শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শ্রেণিকক্ষে ও বাইরে বিশেষ সহায়তা প্রদান জরুরি। এজন্য প্রতিটি স্কুল স্থানীয়ভাবে ‘প্যারা-টিচার’ (শিক্ষা-সহায়ক) নিয়োগ দিতে পারে।
দরিদ্র পরিবারের সহায়তা
অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের জন্য যত দ্রুত সম্ভব মিড-ডে-মিল চালু করা, খাতা-কলম-ব্যাগ বিতরণ করা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে অতিদরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বাড়তি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
Post a Comment