অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার সমালোচনার বিষয়ে ভারতের সমর্থন নেই: বিক্রম মিশ্রি

 

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার সঙ্গে ভারতের কোনো সমর্থন নেই।

গতকাল বুধবার ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এই মন্তব্য করেন বিক্রম মিশ্রি। এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন লোকসভার বিরোধী দলের নেতা ও কংগ্রেসের সদস্য শশী থারুর।

বিক্রম মিশ্রি গত সোমবার ঢাকা সফর করেন। সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও আলোচনা করেন।

ঢাকা সফরের বিষয়ে গতকাল বিক্রম মিশ্রি ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে একটি বিস্তারিত ব্রিফিং দেন।

ব্রিফিংয়ে বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার সঙ্গে ভারতের কোনো সমর্থন নেই। তিনি উল্লেখ করেন, এ বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনো একক রাজনৈতিক দল বা সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ভারত ‘বাংলাদেশের জনগণের’ সঙ্গে সম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে।

বিক্রম মিশ্রি জানান, শেখ হাসিনা তাঁর মন্তব্যের জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগের ডিভাইস ব্যবহার করছেন। ভারত সরকার তাঁকে এমন কোনো প্ল্যাটফর্ম বা সুবিধা প্রদান করেনি, যার মাধ্যমে তিনি ভারতের মাটিতে বসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন। এটি ভারতের ঐতিহ্যগত নীতির অংশ, যেখানে তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয় না।

বিক্রম মিশ্রির এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ শেখ হাসিনা নিয়মিত ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করে আসছেন।

ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, ঢাকা সফরকালে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সরকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং বর্তমান সরকারের সঙ্গে

বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অনেক দোষী সাব্যস্ত ‘সন্ত্রাসী,’ যাঁরা ভারতবিরোধী বক্তব্যে লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ‘অপতথ্য’ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

একাধিক সূত্রের মতে, পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশে ইসকন নেতাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি ব্রিফিংয়ে উত্থাপন করেন। তবে এ বিষয়ে বিক্রম মিশ্রি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া জানাননি।

বিক্রম মিশ্রি কমিটির সদস্যদের আরও জানান যে, তাঁর ঢাকা সফরের সময় তিনি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন মন্দির এবং ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে হামলার ঘটনাগুলো স্বীকার করার গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রতিবেদনগুলোকে অতিরঞ্জিত বা গণমাধ্যমের মনগড়া দাবি হিসেবে উপস্থাপন করলেও, ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কিছু সংস্থা কয়েকটি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এসব ঘটনার নিরপেক্ষ যাচাই প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।

বিক্রম মিশ্রি উল্লেখ করেন, এ ধারায় কথাবার্তা বলার পর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানান।

পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি আরও জানান, কিছু হামলার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, সেগুলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা। এ প্রসঙ্গে বিক্রম মিশ্রির বক্তব্য ছিল, এ ধরনের যুক্তি এই ধরনের হামলাকে ন্যায্যতা দিতে পারে না।

পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি জানান, ঢাকা সফরকালে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি ‘গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও অন্তর্ভূক্তিমূলক’ বাংলাদেশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

বিক্রম মিশ্রি বলেন, গত বছর বাংলাদেশিদের জন্য ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করে ভারত। এই সময়ে বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভিসা ইস্যু করেছে ভারত।

বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’–এর ভিত্তি হিসেবে দেখে না ভারত, বরং ‘ভালো প্রতিবেশী সম্পর্কের’ ভিত্তি হিসেবে দেখে।

পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বিক্রম মিশ্রি জানান, ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পর্যালোচনার বিষয়টি নিয়ে তাঁর কথা হয়নি।

বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বাণিজ্য ও যোগাযোগের সবচেয়ে বড় অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে বিক্রম মিশ্রি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশ রেল, বাস এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথের মাধ্যমে সংযোগ উন্নত করেছে। তবে তিনি জানান, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী রেল পরিষেবা ‘স্থগিত’ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার অভিযোগ নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন ছিল। তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ-সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনায় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। ভারত এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে।

একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, বিক্রম মিশ্রি তাঁর ঢাকা সফরের পর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post